
শেরপুরের নকলা উপজেলার ধনাকুশা গ্রামের ভোরটা শুরু হয় হাঁসের ডাকেই। এই ডাকই নতুন দিনের শক্তি হয়ে ওঠে মনি বেগমের জীবনে। ছোট্ট একটি খামার, বড় সংগ্রাম, আর হাল না ছাড়ার জেদ—এসব নিয়েই আজ তিনি গ্রামের অনুপ্রেরণার প্রতীক।
৩৭ বছর বয়সী মনি বেগম এখন প্রতিদিন সংগ্রহ করেন ৯০–১০০টি হাঁসের ডিম। প্রায় ৫০০ হাঁস নিয়ে তাঁর বর্তমান খামার। খাবার, ওষুধ ও খরচ বাদ দিয়েও তাঁর মাসিক আয় দাঁড়ায় ৪০–৫০ হাজার টাকা।
কিন্তু এই যাত্রা এত সহজ ছিল না।
হতাশা থেকে স্বাবলম্বী হওয়া: মনির শুরুটা ছিল কঠিন
২০০৫ সালে বিয়ে হয় মনি বেগমের। সংসারে দুই সন্তান—এক ছেলে ও এক মেয়ে। কিন্তু ২০১৩ সালে ভেঙে যায় সংসার। সন্তানদের নিয়ে ফিরে আসতে হয় বাবার বাড়িতে।
বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ঢাকায় গিয়ে আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কোয়ালিটি বিভাগে চাকরি নেন। সাত বছর দাঁড়িয়ে কাজ করেছেন প্রতিদিন। তবু নিজেকে নতুনভাবে দাঁড় করানোর স্বপ্ন ছিল অবিচল।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলে ২০২০ সালে ফিরে আসেন গ্রামে—হতাশা, অনিশ্চয়তা আর ক্লান্তি নিয়ে।
ঠিক তখনই জীবনে আলো নিয়ে আসে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) ‘স্বপ্ন প্রকল্প’।
দুই দফায় ৯ দিনের হাঁস পালনের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণই বদলে দেয় তাঁর পথচলা।
এভাবেই শুরু মনির হাঁসের খামারের
চাকরির সঞ্চয়ের ৫০ হাজার টাকা ও UNDP-এর ৫ হাজার টাকার সহায়তা দিয়ে তিনি কিনেন ১০০টি ডিম পাড়া হাঁস।
ভাইয়ের বাড়ির আঙিনায় বানিয়ে ফেলেন একটি ছোট খামার।
নিজের পরিশ্রম, সময় ও মনোযোগ দিয়ে খামারটা দিনে দিনে বড় করেছেন।
সকালে ডিম সংগ্রহ, দুপুরে খাবার দেওয়া, পানি পরিষ্কার, সন্ধ্যায় হাঁস ঘরে তোলা—সব কাজ একাই করে থাকেন।
আজ সেই ছোট খামারই তাঁর আত্মবিশ্বাস, সম্মান আর স্বনির্ভরতার শক্তি।
মনির খামার বদলে দিচ্ছে আরও নারীর জীবন
মনির সাফল্য শুধুই তাঁর না—এটি আরও তিনজন নারীর জীবনে এনে দিয়েছে কাজের সুযোগ।
তাঁদের একজন লাকি আক্তার, যিনি স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর তিন সন্তান নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন।
তিনি বলেন,
“এই কাজের আয়ে বাচ্চাদের পড়াতে পারছি। তিন বেলার খাবারের দুশ্চিন্তাও নেই।”
UNDP জামালপুর–শেরপুর প্রতিনিধি মো. আমির আলীর তথ্যমতে, নালিতাবাড়ী ও নকলা উপজেলায় ৭৫৬ জন নারীর জীবন বদলে দিচ্ছে এই প্রকল্প।
নারীরা শিখছেন—হাঁস-মুরগি পালন, সেলাই, দোকান পরিচালনা, গরু-ছাগল পালনসহ নানা দক্ষতা।
পরিশ্রম ও স্বপ্ন—মনির শক্তি
বসতভিটা না থাকলেও নিজ পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গল্পটি আজ মনির সবচেয়ে বড় অর্জন।
তিনি চান—নিজের খামার আরও বড় করতে এবং ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধী ও অবহেলিত নারীদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করতে।
তাঁর কথায়—
“নিজের উপার্জনে চললে পরিবারও সম্মান করে, সমাজও মূল্য দেয়।”
শেষ কথা
মনি বেগমের গল্প শুধু একজন নারীর সংগ্রাম ও জয়ের গল্প নয়—এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের অদম্য শক্তির প্রতিচ্ছবি।
হাঁসের খামারের মতো ছোট একটি উদ্যোগই আজ তাঁর জীবনে এনে দিয়েছে সম্মান, স্থিতি ও স্বপ্নের নতুন দিগন্ত।
এমন আরও নারীর গল্পই বদলে দেবে বাংলাদেশকে—একটি স্বনির্ভর, সক্ষম, সমান সুযোগের দেশে।