কৃষিখেত থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চ—জয়িতা রহিমার সফলতার গল্প

বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের ছোট্ট গ্রাম ইটনা উপজেলার চরাঞ্চল। চারদিকে ধানক্ষেত আর নদীঘেরা এই গ্রামের এক তরুণীর গল্প—রহিমা খাতুন (২৯)। যাঁর জীবনের শুরুটা ছিল অবহেলা, দারিদ্র্য আর সংগ্রামের; আর পথচলার গন্তব্য আজ আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা মঞ্চে।

শুরুটা অভাব ও বাধার মধ্যেই

রহিমার বাবা ছিলেন একজন কৃষিশ্রমিক। পাঁচ ভাইবোনের সংসারে প্রতিদিনই ছিল টাকার টানাপোড়েন। সপ্তম শ্রেণির পর অর্থাভাবে তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় কারখানায় কাজ করা কিংবা বাচ্চা দেখাশোনার মাধ্যমে সামান্য আয় করতেন। এরই মধ্যে তাঁর বিয়ে হয়, কিন্তু স্বামীর অত্যাচার ও সংসারের অস্থিরতায় বছর দুয়েকের মধ্যে ভেঙে যায় সেই সম্পর্ক।

এক সন্তান নিয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়িতে—যেখানে তাঁকে বলা হয়েছিল, “মেয়ে হয়ে একা বাঁচা খুব কঠিন।”

কিন্তু এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর লড়াই।

বন্ধ দরজার মাঝে নতুন সুযোগ

২০২১ সালে স্থানীয় নারী উন্নয়ন ফোরামের মাধ্যমে তিনি কৃষিপণ্যের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন—ঘরোয়া আচার, মসলা, শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং প্যাকেজিংয়ের ওপর।

মোট ৫,০০০ টাকার সঞ্চয় নিয়ে শুরু করেন “চর-নন্দিনী ফুডস”—একটি ছোট উদ্যোগ যা তিনি নিজ বাড়ির উঠোনে চালাতেন।

প্রথম দিকে প্রতিদিন মাত্র ৩০০–৪০০ টাকার পণ্য বিক্রি হতো। কিন্তু মানসম্মত খাবার ও পরিচ্ছন্ন প্যাকেজিংয়ের কারণে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।

পরিবর্তনের আসল মুহূর্ত

২০২৩ সালে জেলা প্রশাসনের একটি প্রদর্শনীতে তাঁর পণ্য প্রশংসা পায়। সরকারি নারী উদ্যোক্তা সহায়তায় তিনি পান ২ লাখ টাকার সুদমুক্ত ঋণ। অনলাইন বিক্রি শুরু করেন, তৈরি করেন ফেসবুক পেজ।

আজ তাঁর ব্র্যান্ড প্রতিদিন ৫০–৬০টি ডেলিভারি করে, মাসিক আয় ৬০,০০০–৮০,000 টাকা।

গ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক সম্মেলন

২০২৪ সালে UN Women ও ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত “Women Entrepreneurship Summit”-এ বাংলাদেশের উদ্যোক্তা প্রতিনিধি হিসেবে আমন্ত্রণ পান রহিমা। লন্ডনে আয়োজিত সেই সম্মেলনে তিনি উপস্থাপন করেন—কীভাবে গ্রামীণ নারীরা স্থানীয় উপকরণ দিয়ে ব্যবসা তৈরি করে নিজেদের ও সমাজকে বদলে দিতে পারেন।

তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তুলে ধরেন—

“নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানে পুরো পরিবারের শক্তি বৃদ্ধি।”

আজ রহিমা কী করছেন?

  • নিজের ব্যবসায় কর্মসংস্থান দিয়েছেন ১১ জন নারীকে
  • মাসে ২৫০–৩০০ কেজি স্থানীয় কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করেন
  • নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেন গ্রামের তরুণীদের
  • লক্ষ্য—চর অঞ্চলের নারীদের নিয়ে কো-অপারেটিভ স্থাপন

শেষ কথা

গ্রামের ঘরের মেয়েটি আজ অনুপ্রেরণার নাম—রহিমা খাতুন। তাঁর গল্প শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যের নয়; এটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের জাগরণ, স্বপ্ন আর সংগ্রামের প্রতীক।

এমন নারীরাই বদলে দিচ্ছেন দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও ভবিষ্যৎ।